top of page
mass flip grey.png

মাস স্টুডিও থেকে বার্তা

আমাদের মাস স্টুডিওর চার জনের ছোট্ট দলটির মোটামুটি সবাই আমরা স্থপতি। স্থাপত্যের পড়াশোনা, চর্চা এবং আলোচনায়, সার্বজনীনগম্যতার বিষয়টি সময়ে সময়ে উঠে আসে, তবে সেটা একটু ছাড়া ছাড়া ভাবেই। স্থাপনায় সার্বজনীনগম্যতার বিষয় গুলোর অবস্থান আমাদের নিয়ম নীতির বইগুলোর পরিশিষ্টে বা বিশেষ দ্রষ্টব্যে থাকার কারনেই কিনা, সার্বজনীনগম্যতা নিশ্চিত করার বিষয়টি এখনও সবার মধ্যে সহজাত নয়, বা নান্দনিকতা নিশ্চিত করার মত আত্তীকৃত অবস্থায় নয়। তাছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সার্বজনীনগম্যতার নিয়ম নীতির অধিকাংশই ইংরেজিতে লেখা, বাংলায় অধিগম্য কোনও ফরম্যাটে তো নয়ই। ২০১৯-এ বি-স্ক্যানের সাথে, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা নানান পর্যায়ের মানুষদের নিয়ে করা সার্বজনীনগম্যতার অডিটের সময়, একটি বাংলা ভাষায় সহজবোধ্য ভাবে লেখা পূর্ণাঙ্গ সার্বজনীনগম্যতার নির্দেশনাবলীর সত্যিকার প্রয়োজনীয়তা এবং অভাব তীব্র ভাবে অনুভব করি।


আমরা নিজেদের অনেক সৌভাগ্যবান মনে করি যে বি-স্ক্যানের সাথে সেই উপলব্ধি বাস্তবায়িত করার একটা সুযোগ আমরা পেয়েছি। বাংলায় লেখা সার্বজনীনগম্য একটি নির্দেশনাবলী তৈরি করা, যার আলোকে যে কেউ একটি স্থাপনা সার্বজনীনগম্য করে তুলতে কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে বা একটি স্থাপনা কতটুকু সার্বজনীনগম্য তার একটা সম্যক ধারণা পেতে পারেন। কাজটি হাতে নেয়ার পর গবেষণা অংশে আমরা শুরুতেই বিভিন্ন দেশের সার্বজনীনগম্যতার স্ট্যান্ডার্ড থেকে ধারণা নেয়া শুরু করি, তবে অবশ্যই আমাদের প্রধান রেফারেন্স হিসেবে ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড, ২০২০ এর তৃতীয় অধ্যায়ের পরিশিষ্ট ‘ডি’, ইউনিভার্সাল অ্যাক্সেসিবিলিটি’ অংশটিকে রাখি। আমরা চেষ্টা করেছি বিএনবিসি ২০২০ এ প্রণীত সার্বজনীনগম্যতা সংক্রান্ত সকল বিষয় যেন আমাদের লেখায় উঠে আসে, এবং আমাদের অতিরিক্ত প্রস্তাবিত নির্দেশনাবলীর কোনটি যেন বিএনবিসি ২০২০-এর কোনও কোডের সাথে অসঙ্গতিপূর্ণ বা সাংঘর্ষিক না হয়।


নির্দেশনাবলীটি যেন সার্বজনীন ব্যবহার উপযোগী হয়, সেই চিন্তা থেকে মূল কিছু বিষয় মাথায় রেখে নির্দেশনাগুলো লেখা হয়েছে। প্রথমত, কোনও একটি নির্দেশনা যেন শুধুমাত্র শুনে বোঝা যায় সেদিকে বেশ খানিকটা জোর দেয়া হয়েছে, ‘চিত্র বা ছক অনুযায়ী’ হবে বলে ছেড়ে দেয়া হয় নি। দ্বিতীয়ত, প্রতিটি নির্দেশনা যেন একক ভাবে পড়ে বা শুনে পূর্ণ অর্থ দাঁড়া করানো যায়, সেজন্য প্রতিটি নির্দেশনাতেই অন্তত একবার সেটির প্রসঙ্গটি বলে নেয়া হয়েছে। এতে আরেকটি অতিরিক্ত সুবিধা যা হয়েছে তা হল, নির্দেশনা গুলো খুঁজে বের করা অনেকটা সহজ হয়েছে। তৃতীয় বিষয়টি একটু সামগ্রিক, কোনও একটি বিষয়ের নির্দেশনাগুলো পড়ার সময় খুব বেশি অন্য কোনও বিষয়ের নির্দেশনার দিকে ঠেলে দেয়া হয়নি। অন্য নির্দেশনার কথা উল্লেখ থাকলেও শুধুমাত্র নির্দেশনাটির ক্রম উল্লেখ না করে ছোট প্রাসঙ্গিক বর্ননাও দিয়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়াও কোনও শব্দের লিখিত সংক্ষিপ্ত রূপ এবং দুর্বোধ্য পরিভাষা পরিহার করা হয়েছে। সর্বোপরি বেশ কিছু নির্দেশনার পর তার কারণ বা প্রয়োগটিও ব্যাখা করা হয়েছে, যেন বিষয়টি ধারণাগত দিক থেকে আরও পরিষ্কার হয়।

এ সবকিছু শেষে, নির্দেশনাবলীটি প্রথমবার পড়তে হয়ত একটু বেশি সময় লাগতে পারে, তবে দীর্ঘ মেয়াদি ব্যবহারে এইরকম স্বয়ংসম্পূর্ণ ভাবে লেখা নির্দেশনাগুলো অধিক কার্যকরী হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।


সর্বোচ্চ সংখ্যক পাঠকের সুবিধার্থে এবং সমান এক্সপেরিয়েন্স এর কথা মাথায় রেখে, চিত্র গুলোতে কেবলমাত্র সাদা, কালো, নীল, ও হলুদ ছাড়া অন্য রঙের ব্যবহার করা হয়নি। নির্দেশনা ও সংশ্লিষ্ট চিত্রের মধ্যকার সংযোগ স্থাপন সহজ করার জন্য, নির্দেশনার আলোচ্য বিষয়গুলো চিত্রে হলুদ রঙ দ্বারা চিহ্নিত করে দেয়া হয়েছে, এবং চিত্রের লিখিত অংশ অন্যান্য লিখিত অংশের থেকে কিছুটা আলাদা করতে নীল রঙ ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সাথে নির্দেশনার লিখিত অংশের মত চিত্রেও একই জাতীয় শব্দ এবং একই আকারের অক্ষর ব্যবহার করা হয়েছে। চিত্র গুলো সঠিক অনুপাতে অঙ্কিত যেন সহজেই বাস্তব উদাহরণ এর সাথে মিলিয়ে দেখা সম্ভব হয়।


নির্দেশনাবলীটি এপর্যন্ত দাঁড়া করাতে গবেষণা, অনুবাদ, নতুন করে লেখা, টাইপিং, স্কেচ, দিমাত্রিক, ত্রি-মাত্রিক ছবি তৈরি, পোস্ট প্রোডাকশন, যাবতীয় আইকন, মুঠোফোন বান্ধব সার্বজনীন ব্যবহার উপযোগী একটি বাংলা ওয়েবসাইট ডিজাইন এবং ডেভেলপমেন্ট, বই এর ডিজাইন, অক্ষরবিন্যাস, লে-আউট….. এবং অনেক অনেক আলোচনা ও বিতর্ক -সব মিলিয়ে আমাদের এই ছোট্ট দলটির আসলেই বেশ খানিকটা হিমশিম খেতে হয়েছে কিন্তু একটি ‘করার মত কাজ’ করার পরিতৃপ্তি আমাদের প্রতিনিয়ত প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেই সাথে বি-স্ক্যানের অদম্য অক্লান্ত কিছু মানুষের পাশে থেকে আমরা সত্যিকার অর্থে অনুপ্রাণিত হতে পেরেছি, যাদের চিন্তা, কাজের ব্যাপ্তি ও গতির সামনে নিজেদের অজস্র বাধা, বিপত্তি, অজুহাত বারবার তুচ্ছ মনে হয়েছে।


অনেক বিষয় আরও একটু বিস্তৃত ভাবে বর্ণনা করা সম্ভব হল না, জানা-অজানা অনেক ত্রুটি থেকে গেল; ধরে নিচ্ছি প্রথমটা ভুল করার জন্যই। ওয়েব সাইটে সময়ে সময়ে আলোচ্য বিষয় গুলো আরও উন্নত থেকে উন্নততর করার চেষ্টা করব। বই, ওয়েবসাইট, নির্দেশনাবলী সব কিছুর গঠনমূলক সমালোচনার পথ সব সময়ই সবার জন্য খোলা থাকলো। আলোচনা সমালোচনার পর ওয়েবসাইটটি মোটামুটি একটি সমৃদ্ধ স্থিতিশীল পর্যায়ে পৌঁছালে পূর্ণাঙ্গরূপে বাংলায় অধিগম্য একটি সংস্করণ হয়ত তৈরি হয়ে যাবে।


বাংলা সার্বজনীনগম্য নির্দেশনাবলী নিয়ে আমাদের কাজের পরিকল্পনার তিনটি পর্যায়ের প্রথম পর্যায় একভাবে শেষ হল। আমরা বাংলা সার্বজনীনগম্য নির্দেশনাবলী-টিকে ‘বাংলাদেশ সার্বজনীনগম্য নির্দেশনাবলী’তে রুপান্তরিত হওয়ার ছোট্ট একটা স্বপ্ন দেখি, আর একটা সার্বজনীনগম্য বাংলাদেশের একটু বড় একটা স্বপ্ন দেখি। পরিশেষে, কাজটির মাধ্যমে আর কিছু অর্জিত হোক বা না হোক, এখন থেকে সার্বজনীনগম্য বাংলাদেশ গড়ার আলোচনাটি অন্তত সবাইকে নিয়ে মাতৃভাষা বাংলায় করা সম্ভব হবে, এইটুকু আশা রাখি।

ফাহিম হাসিন সহন

খতিব তানিজা বারি আকাশ

মোস্তাক আহমেদ

bottom of page